লেখক I মোহাম্মাদ জামাল উদ্দিন I বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার (ইইই), বুয়েট এবং এমবিএ (আরআরইউ)
ফোর্বসের মতে, ২০৫০ সালের মধ্যে, নতুন পণ্য ডিজাইনের জন্য ৯৫% ইলেকট্রনিক্সে IoT প্রযুক্তি থাকবে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে এটি ক্লাউড এবং ইন্টারনেটের সাথে সংযুক্ত থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। মহাকাশ পর্যটন ২০৫০ সালে সম্ভব হতে পারে এবং তা হবে সম্ভবত খুব ধনী ব্যক্তিদের জন্য।
যখন আমরা ২০৫০ সালের কথা চিন্তা করি তখন মনে হয় এটি এখন থেকে বহুযুগ পরে এবং আমরা একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন জগত কল্পনা করি। কিন্তু বাস্তবে এটি এখন থেকে মাত্র ৩০ বছর পরে এবং আমরা ইতিমধ্যেই কিছুটা অনুমান করতে পারছি যে সেই সময়ের মধ্যে কী করা সম্ভব হবে।
২০৫০ সালে উল্লেখযোগ্য প্রযুক্তিগত অগ্রগতির কারণে বিশ্বকে আমরা ভিন্নভাবে দেখবো এবং এইগুলোর কিছুটা নমুনা নিম্নে আলোচনা করা যাক।
স্পেস এলিভেটর (Space Elevator):
স্পেস এলিভেটর বলতে তাত্ত্বিকভাবে লম্বা বর্ধনশীল এক শিকলকে বোঝায়, যেটি পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে মহাকাশ পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। এমন একটি কাঠামোর ভরকেন্দ্র পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে ৩৫,৭৮৬ কিলোমিটার উপরে জিওস্টেশনারি অরবিটে অবস্থান করবে। এখানে জিওস্টেশনারি অরবিট হলো সেই বৃত্তাকার কক্ষপথ যার পর্যায়কাল ২৪ ঘণ্টা, অর্থাৎ পৃথিবীর পর্যায়কালের সমান। এই পথ দিয়ে চলাচল করতে পারবে বিভিন্ন তড়িৎচুম্বকীয় যানবাহন, মানুষ ও নানা ধরণের ভারী মালামাল। বর্তমানে মহাকাশে যাতায়াতের একমাত্র উপায় রকেট হলেও এলিভেটরের মাধ্যমে এই যাতায়াত অনেক কম খরচে ও নিরাপদে পরিচালনা করা সম্ভব হবে।
সত্যিকার অর্থেই এই কল্পবিজ্ঞানকে বাস্তবায়িত করার প্রচেষ্টা চলছে। জাপানের বিখ্যাত নির্মাণ সংস্থা ওবায়াশি কর্পোরেশন ঘোষণা দিয়েছে, তারা ২০৫০ সালের মধ্যেই এটি নির্মাণ করবে। আবার চীন ২০৪৫ সালের মধ্যে এমন একটি এলিভেটর তৈরি করতে চায়। যদিও স্পেসএক্স-এর প্রতিষ্ঠাতা এলন মাস্ক এমন একটি এলিভেটর তৈরির সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়েছেন। তবুও এই প্রজেক্টের সাথে জড়িত অনেক প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন যে, আমরা আমাদের জীবদ্দশাতেই একটা স্পেস এলিভেটর দেখে যেতে পারবো। এই শতাব্দীর মাঝেই হয়তো মহাকাশে যাওয়ার এই বিকল্প রাস্তা তৈরি হয়ে যাবে।

ছবিঃ স্পেস এলিভেটর
বায়োনিক চোখ (Bionic Eye):
বিভিন্ন কারণে দৃষ্টিহীনতায় ভুগছেন এমন ব্যক্তিরা চিকিৎসার মাধ্যমে সেই দৃষ্টি ফিরে পেতে পারেন। কিন্তু যাদের চোখ নেই কিংবা কোনো কারণে চোখ হারিয়ে ফেলেছেন তাদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ আসছে বায়োনিক চোখ। মস্তিষ্কে প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে বিশ্বের প্রথম বায়োনিক আই বা চোখ নির্মিত হতে যাচ্ছে। এ উদ্ভাবনের ফলে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধরা দেখতে পারবেন পৃথিবী।
বিশ্বজুড়ে লাখো মানুষকে আশার আলো দেখাচ্ছে হংকং ও যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকেদের তৈরি ‘বায়োনিক চোখ’ যা দৃষ্টিহীনদের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিতে পারে। রোবোটিক প্রকৌশলীরা অদূর ভবিষ্যতে সফল হওয়ার ব্যাপারে অত্যন্ত আশাবাদি।
বায়োনিক চোখ মূলত মানুষের রেটিনার মতোই কাজ করে। এ জন্য কাঠামোগত যত নিখুঁত নকশা প্রয়োজন তা যুক্ত করেছেন গবেষকেরা। হংকং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (HKUST) গবেষকেরা বলছেন, যাঁদের চোখের দৃষ্টি আংশিক বা পুরোপুরি দৃষ্টিহীন সবার কাজে আসবে এটি।

ছবিঃ বায়োনিক চোখ
হাইপারলুপ টানেল (Hyperloop Tunnel):
যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের জন্যে একটি পরিকল্পিত ও প্রস্তাবিত পদ্ধতি। হাইপারলুপ মূলত এক ধরনের ভ্যাকুয়াম ট্রেন। হাইপারলুপ প্রযুক্তির মাধ্যমে খুব অল্প বায়ুচাপ বিশিষ্ট এক ধরনের বিশেষ ক্যাপসুল মাধ্যমে মানুষ ও পণ্য পরিবহন করা যাবে। সাধারণ ট্রেনে বগি বা কামরা থাকলেও হাইপারলুপ ট্রেনে থাকবে ক্যাপসুল বা পড। এ ধরনের পড একটি টানেল বা টিউবের মধ্য দিয়ে চলাচলের ফলে বাতাসের চাপ থাকবে শূন্য। যার ফলে প্রায় বাঁধাহীনভাবে চলাচল করতে পারবে ট্রেনটি। আর এই টানেল বা টিউব নির্মিত হবে ম্যাগনেটিক লেভিটেশন বা ম্যাগলেভ প্রযুক্তির মাধ্যমে।
বর্তমানে অনেক দেশেই ম্যাগলেভ প্রযুক্তিতে ট্রেন চলাচল করছে। সেগুলো মূলত বুলেট ট্রেন হিসেবে জনপ্রিয়। হাইপার লুপ-এর ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তি থাকবে টানেলের ভেতরে। যা চুম্বকের চুম্বকত্ব ধর্মকে কাজে লাগিয়ে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক সাসপেনশন ও ইলেকট্রোডাইনামিক সাসপেনশন পদ্ধতিতে পডগুলো ভাসিয়ে রাখবে এবং অস্বাভাবিক গতিতে ছুটে চলতে সাহায্য করবে।
এই ট্রেন একটানা ৯৩০ মাইল বা ১ হাজার ৫০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারে। যদি সর্বোচ্চ গতিতে চালানো সম্ভব হয় তাহলে এই পথ পাড়ি দিতে ৮০-৯০ মিনিটের বেশি সময় লাগে না।

ছবিঃ হাইপারলুপ টানেল
ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস (Brain–Computer Interface):
ইনফ্রারেড সুইচ, মোশন সেন্সর, স্পিচ জেনারেটেড কমান্ড, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি, অগমেন্টেড রিয়েলিটি সহ আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সভিত্তিক স্মার্ট অ্যাসিস্ট্যান্টের মতো উন্নত প্রযুক্তি কম্পিউটারের সাথে যোগাযোগের এই ব্যবস্থাকে আরো সহজ করে দিয়েছে। অনেক মানুষই উন্নত প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে নিজের অসম্পূর্ণতা, অক্ষমতাগুলোকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর সাথে সাথে সীমিত পর্যায়ের কর্মক্ষমতাকে বাড়িয়ে নিচ্ছে। হাত-পা নাড়াতে পারছে না এমন যে কেউ হুইল চেয়ার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে। দৃষ্টিশক্তি নেই এমন যে কেউ চাইলেই ভয়েস নিয়ন্ত্রিত সফটওয়্যারের সাহায্যে কম্পিউটারকে নির্দেশনা দিতে পারছে, ফলাফল পাচ্ছে স্পিকারের মাধ্যমে। অর্থাৎ, কম্পিউটারের সাথে ইন্টার্যাকশনের জন্য মানুষকে কোনো না কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাহায্য নিতে হয়, সামান্য হলেও পেশি শক্তির ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু যাদের দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি ও বাকশক্তি নেই, স্টিফেন হকিংয়ের মতো পুরোপুরি বোধশক্তিহীন, তারা কিন্তু চাইলেই কম্পিউটারের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারবে না। অর্থাৎ, প্রযুক্তির এত সুবিধা থাকতেও সেগুলো ব্যবহারের সুযোগ তাদের নেই। থাকলেও তা সীমিত পর্যায়ে। আর এই জায়গাটিতেই ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেসের আগমন।

ছবিঃ ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস
ব্লকচেইন প্রযুক্তি (Blockchain Technology):
ব্লকচেইন টেকনোলজি হল একধরনের ডিজিটাল লেজার টেকনোলজি যা তথ্য রেকর্ড করে। বিশেষ করে লেনদেনের তথ্য এমনভাবে হিসাব করে যাতে সেগুলো পরিবর্তন করা, হ্যাক করা বা সিস্টেমে প্রতারণা করা প্রায় অসাধ্য। এই লেনদেনগুলি ব্লকচেইনে কম্পিউটার সিস্টেমের সম্পূর্ণ নেটওয়ার্কের সঙ্গে বিতরণ এবং রেকর্ড করা হয়। বিটকয়েন, ইথেরিয়ামের মতো ব্লকচেইন প্রযুক্তি ভিত্তিক পণ্য (বিকল্প মুদ্রা) গত কয়েক বছরে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
ব্লকচেইন প্রযুক্তি এত জনপ্রিয় হওয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল, এর স্বচ্ছতা এবং অপরিবর্তনীয়তা। এটি একটি বিকেন্দ্রীভূত পিয়ার-টু-পিয়ার নেটওয়ার্ক সিস্টেম যার দায়িত্বে কোনও নির্দিষ্ট ব্যক্তি নেই যে অন্যান্য কেন্দ্রীভূত, ঐতিহ্যবাহী লেনদেনের মতো লেনদেন পরিচালনা বা নিয়ন্ত্রণ করবে। এই প্রযুক্তি যারা তৈরি করেছে এবং যারা ব্যবহার করছে তাদের পারস্পরিক বোঝাপড়ার উপর কাজ করে। এটাই ব্লকচেইন প্রযুক্তিকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে।
ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্লকচেইন প্রযুক্তির উপর ভিত্তি করে তৈরি করা। আশা করা হচ্ছে ২০৫০ সালে ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার এবং ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহার সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে যাবে।

ছবিঃ ব্লকচেইন প্রযুক্তি
ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (VR) এবং অগমেন্টেড রিয়েলিটি (AR):
ভার্চুয়াল রিয়েলিটি শব্দের অর্থ হচ্ছে “সামনের বাস্তবতা “। একে এক ধরনের নির্দিষ্ট বাস্তবিক অনুকরণ বলা যেতে পারে। প্রকৃতপক্ষে বাস্তব নয়, কিন্তু বাস্তবের ধারণা সৃষ্টি করতে সক্ষম এমন কল্পনানির্ভর বিষয় অনুভব করার ত্রিমাত্রিক অবস্থা উপস্থাপন। ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে ত্রিমাত্রিক ইমেজ তৈরির মাধ্যমে অতি অসম্ভব কাজও সম্ভব করা যায়। কল্পনার পাখায় ভর করে ইচ্ছে করলে প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরতম অঞ্চলে ঘুরে আসা যায়, মানুষের মস্তিষ্কের নিউরন সংযোগের উপর দিয়ে হাঁটা এবং জুরাসিক পার্কের সেই অতিকায় ডাইনোসরের তারাও খাওয়া যায়।
অগমেন্টেড রিয়েলিটি হলো এমন এক প্রযুক্তি, যাকে বাস্তব জগতের এক বর্ধিত সংস্করণ বলা যেতে পারে। আপনি বাস্তবে যা দেখবেন, তার উপর কম্পিউটার নির্মিত একটি স্তর যুক্ত করে দেবে অগমেন্টেড রিয়েলিটি (AR)। আর তখন সেই বাস্তব এবং ভার্চুয়ালের সংমিশ্রণে তৈরি হবে এক নতুন অনুভূতি, সব কিছুকে এক ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা। আপনি যা দেখতে চাইবেন, আপনার চাহিদা অনুযায়ী আপনাকে তা-ই দেখাবে অগমেন্টেড রিয়েলিটি। শুধু কম্পিউটার নির্মিত চিত্রই নয়, এতে থাকতে পারে শব্দ, ভিডিও, গ্রাফিক্স, স্পর্শ করার অনুভূতি, এমনকি জিপিএস ডাটাও।
ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি ব্যবহার করা হয়, কোনো ট্যুর করার জন্য, থ্রিডি ম্যাপস, থ্রিডি মুভিজ, থ্রিডি গেমস ইত্যাদি উপভোগ করার জন্য। অন্যদিকে, অগমেনটেড রিয়্যালিটি ব্যবহার করা হয় ইন্টারেক্টিভ কন্টেন্ট, গেমিং অথবা আপনার দুনিয়াতে যদি নতুন কিছু উদ্ভবন করতে চান তার জন্য।

ছবিঃ ভার্চুয়াল রিয়েলিটি এবং অগমেন্টেড রিয়েলিটি
এআই (AI):
আর্টিফিশিইয়াল ইন্টেলিজেন্স এর ব্যাখ্যা যদি সহজভাবে বলতে হয় তাহলে বলবো মানুষের চিন্তাভাবনা কে কৃত্রিম ভাবে কম্পিউটার বা কম্পিউটার প্রযুক্তি নির্ভর যন্ত্রের মাধ্যমে রূপ দেওয়ার ব্যবস্থা। অর্থাৎ এটি এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে একটি যন্ত্র মানুষের মত চিন্তা করতে পারবে। যাকে বলা যায় ভার্চুয়াল হিউম্যান ব্রেইন। এক কথায় বলতে গেলে, মানুষের সমান বুদ্ধিমত্তা দিয়ে কম্পিউটার প্রোগ্রাম বা মেশিন তৈরীর সাইন্স বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স।
বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন যে, ভবিষ্যতে মানুষের কর্মক্ষেত্রের বেশিরভাগ জায়গা রোবোটিক্স দখলে নিয়ে নিবে। বর্তমানে বিশ্বের অনেক বড় বড় কারখানা থেকে শুরু করে, যুদ্ধক্ষেত্রে ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যাবহার হয়ে থাকে। আমরা এতোদিনে হয়ত ড্রোনের নাম শুনেছি। এই ড্রোন নিমিষে একটি দেশের রাডার ফাঁকি দিয়ে ঢুকে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে আসতে পারে। অথচ এই ড্রোন চালাতে কোনো পাইলটের প্রয়োজন হয়না। এটি নিজে থেকে নিজের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কে ব্যাবহার করে খুব দক্ষতার সাথে কাজ সেরে আসতে পারে। ২০৫০ সালে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বেশিরভাগ পেশায় মানুষকে ছাড়িয়ে যেতে পারে।
আশা করা হচ্ছে আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ সারা পৃথিবী উপরে উল্লেখিত প্রযুক্তি গুলোর সফলতা পাবে এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন এক নতুন পৃথিবীতে বসবাস করবে।

ছবিঃ এআই
কন্টেন্ট উৎসঃ ইন্টারনেট, নিউজ পেপার ইত্যাদি।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.