লেখক I অধ্যাপক ডঃ মোঃ আতাউর রহমান I পানি সম্পদ কৌশল বিভাগ, বুয়েট, ঢাকা

চারদিকে পানি দ্বারা পরিবেষ্টিত ভূ-খন্ডকে দ্বীপ বলা হয়। সমুদ্র উপকূলে নদীর মোহনায় পলি জমে যে দ্বীপ সৃষ্টি হয় তা যদি মাত্রাবিহীন বাংলা বর্ণ ‘ব’ এর আকৃতি হয় তখন তাকে ব-দ্বীপ বলে। আবার গ্রিক প্রতীক D  (ডেল্টা) দেখতে মাত্রাবিহীন বাংলা বর্ণ ‘ব’ এর মতো বিধায় ব-দ্বীপকে ডেল্টা (উবষঃধ) বলা হয়। বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ সম্পর্কে জানার আগে আমাদেরকে জানতে হবে বাংলাদেশকে কেন ডেল্টা বলা হয়। হিমালয় পর্বতমালা হতে উৎপন্ন হয়ে বিশাল জলরাশি ও পলিমাটি নিয়ে ছুটে চলা দুটি বড় নদী – গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র – বঙ্গোপসাগরে পতিত হওয়ার আগে পলি পতনের মাধ্যমে যে বিস্তীর্ণ প্লাবণ ভূমি সৃষ্টি করেছে তা বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের অংশজুড়ে অবস্থিত। অসংখ্য নদীবেষ্টিত এই অঞ্চলটি ‘ব’ আকৃতির হওয়ায় একে Bengal Delta বা বঙ্গীয় ব-দ্বীপ বলা হয়।  পশ্চিমে পশ্চিমবঙ্গের হুগলী নদী থেকে শুরু করে পূর্বে বাংলাদেশের মেঘনা নদী পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকাটি Bengal Delta এর অন্তর্ভূক্ত, যার সিংহভাগ অংশই বাংলাদেশে অবস্থিত। এটি পৃথিবীর বৃহত্তম নদীভিত্তিক ব-দ্বীপ এবং তা বিশ্বের উর্বরতম অঞ্চলগুলোর মধ্যে অন্যতম বলে একে সবুজ ব-দ্বীপও বলা হয়ে থাকে। এখন আসা যাক বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ প্রসঙ্গে। হিমালয় অববাহিকার নীচু অঞ্চলে পলিমাটি দ্বারা গঠিত এবং অসংখ্য নদী পরিবেষ্টিত বাংলাদেশ একদিকে যেমন একটি অন্যতম উর্বর অঞ্চল, অপরদিকে এর ভৌগলিক অবস্থানের কারণে এখানে বিভিন্ন প্রাকৃতিক প্রতিক‚লতা মোকাবেলা করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। অতিবৃষ্টি, বন্যা, খরা, নদীভাঙ্গন, জলোচ্ছাস, নদীর তলদেশে পলিপতন, লবণাক্ততা এসব প্রাকৃতিক চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা করা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত কঠিন। আটলান্টিক মহাসাগরের উত্তর সাগরের তীরে অবস্থিত ইউরোপের দেশ নেদারল্যান্ডসের এর প্রাকৃতিক প্রতিক‚লতা সমূহের সাথে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক প্রতিক‚লতা সমূহের বেশ মিল রয়েছে। বন্যা মোকাবেলা, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবসমূহ মোকাবেলা করার জন্য বিভিন্ন কারিগরী প্রকল্প পরিকল্পনার মাধ্যমে নেদারল্যান্ডস সরকার ২০১১ সালে তাদের দেশের জন্য উবষঃধ চৎড়মৎধসসব নামে একটি প্ল্যান তৈরী করেছে। সেই প্ল্যানের দিক নির্দেশনা অনুযায়ী তারা বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহন করে আসছে। নেদারল্যান্ডসের সেই উবষঃধ চৎড়মৎধসসব এর অনুকরণে এবং নেদারল্যান্ডস সরকারের সহযোগীতায় বাংলাদেশে বন্যা, নদীভাঙ্গন, নদী ব্যবস্থাপনা, নগর ও গ্রামে পানি সরবরাহ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার দীর্ঘ মেয়াদী কৌশল হিসেবে বাংলাদেশ সরকার ২০১৮ সালে “বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০” নামে একটি শতবর্ষী প্ল্যান প্রণয়ন করেছে। ডেল্টা প্ল্যানে ছয়টি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে – বন্যা, নদী ভাঙন, নদী ব্যবস্থাপনা, নগর ও  গ্রামে পানি সরবরাহ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্কাশন। এরই মধ্যে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য কাজ শুরু করেছে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত ‘ডেল্টা গভর্ন্যান্স কাউন্সিল’।  

ডেল্টা গভর্ন্যান্স কাউন্সিলে সদস্য হিসেবে রয়েছেন পরিকল্পনা মন্ত্রী, কৃষি মন্ত্রী, অর্থ মন্ত্রী,  স্থানীয় সরকার মন্ত্রী, খাদ্য মন্ত্রী, ভূমি মন্ত্রী, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী, নৌমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী, পানি সম্পদ মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী এবং পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্যকে এই কাউন্সিলের সদস্য সচিব করা হয়েছে। ধাপে ধাপে বাস্তবায়নযোগ্য এই মহাপরিকল্পনার প্রথম ধাপে ২০৩০ সাল নাগাদ বাস্তবায়নের জন্য গ্রহণ করা হয়েছে ৮০টি প্রকল্প। এর মধ্যে ৬৫টি ভৌত অবকাঠামো প্রকল্প এবং ১৫টি প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, দক্ষতা ও গবেষণা বিষয়ক প্রকল্প। এতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩,৭০০ কোটি ডলার। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয়গুলো কখনও একক আবার কখনও যৌথভাবে কাজ করছে। শতবর্ষী ডেল্টা প্ল্যানে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বন্যা ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয় থেকে রক্ষার কৌশল খুঁজে বের করাকে। এরপর রয়েছে পানির নিরাপত্তা। এ ছাড়া টেকসই নদী-অঞ্চল, জলাভূমি সংরক্ষণ, আন্তঃদেশীয় নদীর পানির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার কথাও বলা হয়েছে ডেল্টা পরিকল্পনায়। ডেল্টা প্ল্যানে চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ছয়টি হটস্পট (ছবি-২), যেগুলো মূলত পানি ও জলবায়ু উদ্ভুত অভিন্ন সমস্যাবহুল অঞ্চল। এগুলো হচ্ছে ২৭,৭৩৮ বর্গ কিলোমিটারের উপকূলীয় অঞ্চল, ২২,৮৪৮ বর্গ কিলোমিটারের বরেন্দ্র ও খরাপ্রবণ অঞ্চল, ১৬,৫৭৪ বর্গ কিলোমিটারের হাওর এবং আকস্মিক বন্যাপ্রবণ অঞ্চল, ১৩,২৯৫ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে থাকা পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল, ৩৫,২০৪ বর্গ কিলোমিটারের নদী ও মোহনা অঞ্চল এবং ১৯,৮২৩ বর্গ কিলোমিটারের নগরাঞ্চল। পরিকল্পনায় হটস্পটভিত্তিক সমস্যাগুলো আলাদা করে তুলে ধরা হয়েছে। সমস্যাগুলোর মধ্যে (১) উপকূলীয় অঞ্চলে – ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছাস, লবণাক্ততা, জলাবদ্ধতা, নদী ও উপকূলীয় এলাকায় ভাঙন, ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়া, (২) বরেন্দ্র ও খরাপ্রবণ অঞ্চলে – স্বাদু পানির প্রাপ্যতা, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়া, অপর্যাপ্ত পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থা, পরিবেশের অবনমন, (৩) হাওর এবং আকস্মিক বন্যাপ্রবণ অঞ্চলে – স্বাদু পানির প্রাপ্যতা, আকস্মিক বা মৌসুমি বন্যা, জলাবদ্ধতা ও অপর্যাপ্ত নিস্কাশন, অপর্যাপ্ত পানি ও পয়ঃনিস্কাশন, (৪) পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে – স্বাদু পানির স্বল্পতা, অপর্যাপ্ত পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থা ও ক্রমহ্রাসমান জীববৈচিত্র সংরক্ষণ, (৫) নদী ও মোহনা অঞ্চলে – বন্যা, পরিবেশের অবনমন, পানি দূষণ, পলি ব্যবস্থাপনা ও নৌ-পরিবহন, নদীগর্ভের পরিবর্তন, ভাঙন ও নতুন চর জেগে ওঠা এবং (৬) নগরাঞ্চলে – অপর্যাপ্ত পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থা, জলাবদ্ধতা, স্বাদু পানির পর্যাপ্ততা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। মহাপরিকল্পনায় প্রত্যেকটি হটস্পটেই পরিবেশের অবনমনকে সাধারণ সমস্যা হিসেবে ধরা হয়েছে।

References: Bangladesh Delta Plan 2100: 21st Century Bangladesh, GED, Bangladesh Planning Commission.

ডেল্টা প্ল্যানের রূপকল্প (vision) হচ্ছে নিরাপদ, জলবায়ু পরিবর্তনে অভিঘাতসহিষ্ণু সমৃদ্ধশালী ব-দ্বীপ গড়ে তোলা। এই মহাপরিকল্পনার মিশন হচ্ছে – দৃঢ়, সমন্বিত ও সময়ের সঙ্গে পরিবর্তনশীল কার্যকরী কৌশল অবলম্বন এবং পানি ব্যবস্থাপনা ন্যায়সঙ্গত করা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত এবং অন্যান্য ব-দ্বীপ সংক্রান্ত সমস্যা মোকাবিলা করে দীর্ঘমেয়াদী পানি ও খাদ্য নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও পরিবেশগত স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা।

ডেল্টা প্ল্যানে উচ্চতর পর্যায়ের ৩টি জাতীয় লক্ষ্য এবং ব-দ্বীপ সংশ্লিষ্ট ৬টি নির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ব-দ্বীপ সংশ্লিষ্ট লক্ষ্যসমূহ উচ্চতর পর্যায়ের লক্ষ্য অর্জনে অবদান রাখবে। উচ্চতর পর্যায়ের লক্ষ্যগুলো হচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্য দূরীকরণ, ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জন এবং ২০৪১ সাল নাগাদ একটি সমৃদ্ধ দেশের মর্যাদা অর্জন। ব-দ্বীপ সংশ্লিষ্ট ৬টি নির্দিষ্ট লক্ষ্য হচ্ছে বন্যা ও জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত বিপর্যয় থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, পানির নিরাপত্তা এবং পানি ব্যবহারে অধিকতর দক্ষতা বৃদ্ধি করা, সমন্বিত ও টেকসই নদী অঞ্চল এবং মোহনা ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা, জলাভূমি এবং বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণ এবং তাদের যথোপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করা, অন্তঃ ও আন্তঃদেশীয় পানি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য কার্যকর প্রতিষ্ঠান ও ন্যায়সঙ্গত সুশাসন গড়ে তোলা এবং ভূমি ও পানি সম্পদের সর্বোত্তম সমন্বিত ব্যবহার নিশ্চিত করা।

প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে উন্নত বাংলাদেশ গঠনে বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ একটি অত্যন্ত যুগোপযোগী পরিকল্পনা। এই প্ল্যান বাস্তবায়নে যে সকল কারিগরী প্রকল্প গ্রহন করতে হবে সেগুলোর পরিকল্পনা, ডিজাইন এবং কন্সট্রাকশন করা আর্থিক দিক থেকে যেমন ব্যয়সাপেক্ষ, একই সাথে কারিগরী দিক থেকেও চ্যালেঞ্জিং। এই চ্যালেঞ্জ গ্রহন করে ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়নের মাধ্যমে সমৃদ্ধ বাংলাদশে বিনির্মানে পানিসম্পদ প্রকৌশলীদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ঢাকা, ০২ ডসিম্বের ২০২৪।

তথ্যসূত্রঃ বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০: একুশ শতকের বাংলাদেশ, জিইডি, বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন।

,

Comments

Leave a Reply