লেখক I স্থপতি রাফিউদ্দিন মাহমুদ I প্রিন্সিপাল আর্কিটেক্ট I ডিফর্ম আর্কিটেক্ট
ব্যাস্ত ঢাকা শহেরর ক্লান্তিময় জীবন থেকে মুক্তি পেতে অনেকেই আজকাল নিজ গ্রামে গিয়ে সময় কাটাতে আগ্রহী হয়ে উঠছেন । দিনকে দিন ঢাকায় মানুষ বাড়ার সাথে সাথে ব্যাস্তানুপাতিকভাবে কমছে নাগরিক সুবিধা। একটু স্বস্তিতে কিছু নিরিবিলি মুহূর্ত একান্ত নিজের মত করে কাটানো যেন এক অলীক কল্পনা। সেই স্বপ্ন নিয়েই আমার ক্লায়েন্ট যখন বললেন তার নিজের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের গোবিন্দপুর গ্রামে একটি ডুপ্লেক্স করতে চান তখন সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম। দক্ষিনমুখী দুইতালা ঘরটি মূলত অবকাশ যাপনের জন্য। ক্লায়েন্ট ছাচ্ছিলেন সপ্তাহান্তে স্ত্রী পরিজন সহ কিছু সময় এইখানে এসে কাটাতে। প্লটটি ক্লায়েন্ট তার পৈত্রিকসূত্রে পেয়েছিলেন যার একপাশে রয়েছে বিস্তীর্ণ খোলা প্রান্তর। সংলগ্ন খেলার মাঠে ক্লায়েন্টের শৈশবকাল থেকে অনেক বিশেষ স্মৃতি রয়েছে। তিনি তার বাসভবন থেকে মাঠের দৈনন্দিন কার্যকলাপ এবং খেলাধুলার সাক্ষী হয়ে স্মৃতিগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করতে চেয়েছিলেন। বাসস্থানটির নক্সা তাই এমনভাবে প্রনয়ন করা হয়েছে যা বাহ্যিক দৃশ্যগুলিকে আলিঙ্গন করে, পারিপার্শ্বিকের সাথে ক্লায়েন্টের মানসিক সংযোগের উপর গুরুত্বদেয়। একটি ভীতিকর বৈপরীত্যের পরিবর্তে স্থাপনাটি সাইটে একটি নম্র উপস্থিতি হিসাবে বিরজ করছে। প্রাথমিক উপকরণ হিসাবে কংক্রিট, কাচ, ইস্পাত, কাঠের ব্যবহারের ফলে একটি নিঃশব্দ রঙের টোন তৈরি হয়। অন্দরমহলে যখন প্রাকৃতিক আলো আসে সময়ের সাথে সাথে সেই আলো এবং ছায়ার একটি নিরন্তর পরিবর্তনশীল নাটক তৈরি হয়।
প্রকল্পটি নির্মাণে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আমি নিজেই সরাসরি নিযুক্ত ছিলাম। এটি ছিল একটি টার্ন-কি প্রকল্প। ছোট পরিসরের স্থাপ্পত্য পরামর্শক অফিস নিয়ে ঢাকার বাইরে গিয়ে কাজ করা যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং ছিল। একজন মাত্র সাইট প্রকৌশলীকে সাথে নিয়ে পুরো প্রকল্প নিজেই সম্পন্ন করি। টানা এক বছর নিরলস কাজ করে শেষ হয় এই স্থাপনাটি। স্থপতি হিসেবে এইটাই ছিল প্রথম টার্ন-কি তে ভবন নির্মাণের অভিজ্ঞতা। ঢাকা থেকে দুই ঘন্টায় পৌঁছে যাওয়া যায় গোপাল্গঞ্জের এই গোবিন্দপুর গ্রামে। প্রতিবার সাইট ভিসিট করতে গিয়ে গ্রামের সবুজ ঘেরা সহজিয়া জীবন কাছ থেকে দেখা হত। ব্যাক্তিগত গাড়ী না নিয়ে বাসে করে সাইটে যেতাম যেন বাস থেকে নেমে ভ্যানে করে সাইটে পৌছাতে পারি কারন গ্রামের চিরায়ত সৌন্দর্য নিরবিচ্ছিন্নভাবে উপভোগ করার সুজোগ হাতছাড়া করতে চাইনি। সেই আনন্দে ভ্রমনের ক্লান্তি নিমেষে দূর হয়ে যেত। মাথায় রেখেছি যথাসম্ভব সহজ কিছু করতে যেন সেখানে আমাদের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটে একি সাথে আধুনিকতার ছোঁয়া থাকে।
ক্লায়েন্টের অভিরুচি অনুযায়ী এইখানে থাকবে দুইটি ভবন-একটি দ্বিতল আরেকটি একতলা ভবন, একতলা ভবনটি মূলত রান্নাঘর, ডাইনিং এবং রক্ষণাবেক্ষণকারীর থাকার যায়গা হিসেবে ব্যাবহৃত হবে। এই নক্সা প্রনয়নে আমার প্রধান বিবেচ্য বিষয় ছিল কম খরচে একটি স্বল্প আয়তনের ভবন নির্মাণ। একটি উঠান ঘিরে দুইটা স্থাপনার নক্সা করা হয়েছে, যেই উঠান ফুলের বাগানের জন্য এবং ইতিমধ্যেই বড় হয়ে যাওয়া কিছু গাছ সংরক্ষনের জন্য রাখা হয়েছে। দুই ভবনের মাঝের উন্মুক্ত যায়গাটি আমাদের গ্রাম বাংলার চিরাচরিত উঠানের মত আবহ তৈরী করে। ডুপ্লেক্স মূল ভবনটি উঠানের পূর্বদিকে এবং উত্তর দিকে ছোট আয়তনের একতলা ভবনটির অবস্থান। বাসস্থানটি বড় প্যানেলের জানালা এবং খোলা টেরেসগুলির দ্বারা আশেপাশের পরিবেশের সাথে সংযোগ স্থাপন করে, ভিতরে এবং বাইরের মধ্যে বাধা কমিয়ে আনতে সহায়তা করে । অল্প পরিসরের জায়গা হলেও প্রবেশ মুখের দ্বিতল উঁচু শুন্যস্থান একটা বিশালতার অনুভূতি দেয়। আউটডোর স্পেসগুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।


এই ভবনের নীচতলায় ৯০০ স্কায়রফিট জায়গার মধ্যে দুইটি বেড্রুম, একটি ড্রয়িং কাম ডাইনিং, একটি বাথরুম রাখা হয়েছে আর পাশ্ববরতী ২৫০ স্কয়ার ফিটের একতলা ভবনে একটি বাথরুম, একটি সারভেন্টস রুম, একটি রন্নাঘর এবং সাথে একটি ডাইনিং রুম রাখা হয়েছে। ঐতিহ্যগতভাবে গ্রামের রান্নাঘরগুলো মুল ভবনের থেকে আলাদা থাকে তাই এইখানেও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। মূল বাসস্থান দুই স্তরে বিভক্ত। নিচতলা এবং দ্বিতীয় তলা। নীচতলায় রয়েছে আনুষ্ঠানিক লিভিং, ডাইনিং এবং দ্বিতীয় তলায় রয়েছে একটি ব্যক্তিগত স্টাডি রুম এবং দুইটি বেড্রুম এবং একটি বিশাল উন্মুক্ত টেরেস যেখানে মালিক এবং তার বন্ধু/ সহকর্মীরা বসে পাশের খোলা প্রান্তর উপভোগ করতে পারে। বাংলার চিরায়ত দোচালা ঘরের প্রতিফলন ঘটাতে ভবনে ঢালু ছাদ ব্যাবহার করা হয়েছে। মেটালের ফ্রেমের উপর সিরামিক টাইলস ভবনটির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রনে যেমন সহায়ক তেমনি সাইটে তার নম্র উপস্থিতি ঘোষনা করে। দোতালার অন্দর সজ্জায় ছাদে কাঠের ব্যাবহার বাংলো আবহ তৈরী করে।







সিঁড়িটি এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যেন শূন্যতায় উল্লম্বভাবে প্রদর্শিত স্টীল আর কাঠের তৈরী কোন ভাস্কর্য। এই সিঁড়ি নির্মাণে বিশেষ মনোযোগ দেয়া হয়েছে, পুরান ঢাকার বাবু বাজারে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যয় করে প্রিতিটি ধাপ, সাপোর্ট বীম- সবকিছু নিজেই বানাই, এমনকি সিড়ির কাঠের হাতলের জন্য কাঠ নির্বাচনে এবং স্যাম্পল তৈরিতে প্রচুর সময় ব্যায় করি কাওরানবাজারে, ঠিক যেমন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র থাকাকালে মেটালের ভাস্কর্যের প্রকল্পগুলো করা হত। এই কাজটা করার সময় মনে হয়েছিল ছাত্র জীবনে ফিরে গেছি।বাহিরের দেয়ালে ফেয়ারফেস কনক্রিট, কাঠ রঙ্গা জানালার পাল্লা এবং কাঠ রঙের ক্ল্যাডিং টাইলসের ব্যাবহার প্রাকৃতিক টোন দেয়ার প্রচেষ্টা।
একটি প্রকল্প ডিজাইন করার সময় ক্লায়েন্টের পছন্দ এবং আর্থিক সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। আমার ডিজাইন প্রক্রিয়া এবং মতাদর্শ হল- প্রত্যেকটি প্রজেক্টই তার নিজস্ব উপায়ে অনন্য। আমি আমার চারপাশ থেকে অনুপ্রেরণা নিই, প্রসঙ্গ থেকে রেফারেন্স আঁকি এবং তারপর প্রয়োজনীয় ডিজাইনের কাছে যাই।”
তরুণ স্থপতিদের উপদেশ হিসেবে বলব-“শিল্পের সাথে সম্পর্কিত অন্য যে কোনো বিষয়ের মতো, যেমন চিত্রকলা, সঙ্গীত বা ফটোগ্রাফি, স্থাপত্য একটি কঠিন বিষয় যা অধ্যবসায়ের সাথে গ্রহণ করা যায়। যে কেউ এই ক্ষেত্রে অগ্রসর হতে চায় তাকে অবশ্যই স্থাপত্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সময় বিনিয়োগ করতে হবে এবং আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।”
আমি স্থাপত্যকে সংস্কৃতি ও প্রকৃতির অংশ হিসেবে দেখি। যদিও মনুষ্যসৃষ্ট, নির্মিত পরিবেশ প্রকৃতির একটি অংশ থেকে যায়, তাই স্থাপত্য এবং নকশায় বৃহত্তর ভালোর জন্য অর্থপূর্ণ এবং অভিজ্ঞতামূলক কাজ অনুসরণ করা উচিত।
আমি বিশ্বাস করি যে বছরের পর বছর ধরে, বাংলাদেশের স্থাপত্যের দৃশ্যকল্প ধারাবাহিকভাবে চ্যালেঞ্জগুলি অতিক্রম করেছে এবং উন্নয়নের দিকে অগ্রসর হয়েছে। আমাদের দেশের স্থপতিদের কাজকে সম্মান করি এবং প্রশংসা করি তাঁদের যারা নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নকশার দিকে যান।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.